লাইলাতুল নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি সকল মুসলমানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ রাতে সকল মুসলমান নারী ও পুরুষ নফল ইবাদত পালন করে। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে শবে বরাতের নামাজ পড়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইসলামিক সকল বিষয় নির্ধারিত হয় চন্দ্র তারিখ হিসেবে। তাই সেই হিসেবে ২৫ তারিখ রোজ রবিবার দিবাগত রাতে শবে বরাত পালন করা হবে। যার জন্য শবে বরাতের নামাজ নিয়ম জানা প্রয়োজন। আপনাদের জন্য সকল বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে আমাদের ওয়েবসাইটে। আজকের পোস্ট থেকে জানতে পারবেন শবে বরাতের বিভিন্ন আমলের ফজিলত। শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস ও শবে বরাত পালন করা জায়েজ নাকি বিদআত তাঁর বিস্তারিত তথ্য।
শবে বরাতের ফজিলত
শবে বরাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। এই রাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
ক্ষমা ও রহমতের রাত:
- হাদিসে বর্ণিত: এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন এবং রহমত বর্ষান।
- মুসলমানরা এই রাতে: ক্ষমা ও মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে থাকেন।
- মুসলমানরা এই রাতে: তাদের ভাগ্যের উন্নতি কামনা করে দোয়া-মোনাজাত করে থাকেন।
ইবাদতের রাত:
- হাদিসে বর্ণিত: এই রাতে ইবাদত করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
- মুসলমানরা এই রাতে: রোজা রাখা, নফল নামাজ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত করা, দোয়া-মোনাজাত করা, এবং দান-খয়রাত করার মাধ্যমে ইবাদত-বন্দেগি করে থাকেন।
অন্যান্য ফজিলত:
- জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত: এই রাতে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম থেকে কিছু বান্দাকে মুক্তি দান করেন।
- দোয়া কবুলের রাত: এই রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের দোয়া কবুল করেন।
- পূর্বপুরুষদের জন্য মাগফিরাতের রাত: এই রাতে মুসলমানরা তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও মাগফিরাত চান।
উল্লেখ্য যে, শবে বরাত পালনের ব্যাপারে কিছু হাদিসের বৈধতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু অঞ্চলে শবে বরাত পালনের ক্ষেত্রে কিছু রীতিনীতি প্রচলিত আছে যা ইসলামের মূলনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শবে বরাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। তবে এই রাত পালনের ক্ষেত্রে হাদিসের নির্দেশাবলী অনুসরণ করা এবং অতিরিক্ত রীতিনীতি থেকে বিরত থাকা উচিত।
শবে বরাত সম্পর্কে কোরআন হাদিসের আলোচনা
একটি সহীহ হাদীস থেকে জানা যায়, এ রাতে আল্লাহ ২ শ্রেণীর মানুষ ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দিবেন। সে দুই শ্রেণী হচ্ছেঃ অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী এবং শিরককারী। এছাড়াও আরও কিছু হাদীসে অন্যান্য কিছু গুনাহের কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমনঃ জাদুকর, পিতামাতার অবাধ্য, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, ব্যভিচারী, গীবতকারী ইত্যাদি। এগুলো যেহেতু সব সময়ের জন্যই খারাপ কাজ। তাই আমাদের উচিত হবে এগুলো থেকে তাওবা করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ শবে বরাতের রাতের যে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হয়েছে আমরা তা লাভ করব।
এ রাতের আমলের ব্যাপারে বলা যায় একাকী ঘরে সাধ্যমত সালাত আদায়, তাসবীহ-তাহলীল করতে পারি। কিন্তু দলবদ্ধ হয়ে মসজিদে বা কোনো স্থানে জমায়েত হওয়া অনুচিত। নবীজি (সা) সারা জীবনে একবার এ রাতে কবরস্থানে গিয়েছেন বলে একটি দুর্বল সনদের হাদীসে এসেছে। আমাদের দেশের অনেকে প্রতি বছর কবরস্থান আর মাজারে গিয়ে জমায়েত হয়। মাজারে গিয়ে মৃত আল্লাহর ওলির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে শিরকে লিপ্ত হয় অসংখ্য মানুষ। শিরকের গুনাহ আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করেন না।
এ রাতকে কেন্দ্র করে আতশবাজি, পটকা ফুটানো, হালুয়া-রুটি, সন্ধ্যার পর গোসল করা এরকম অসংখ্য কুপ্রথা ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। শয়তান আমাদের সামনে বিদআতকে অনেক সুন্দর করে উপস্থাপন করে। বিদআতের মাধ্যমেই আস্তে আস্তে মানুষ গোমরাহী এবং শিরকে লিপ্ত হয়। শয়তান প্রথম দিনই কাউকে শিরকের জন্য ওয়াসওয়াসা দেয় না। সে অল্প অল্প করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। জানেনই তো, একটা বিন্দু থেকে আরেকটা বিন্দু বরাবর চলতে গিয়ে দিক যদি কয়েক ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেয়া হয়। তাহলেও লক্ষ্যের বিন্দুতে পৌঁছানো যায় না। শয়তান ১ ডিগ্রি, ১ ডিগ্রি করে আমাদেরকে ঘুরিয়ে দেয় কুরআন-সুন্নাহ থেকে। বাকিটা এমনি এমনি হয়ে যায়। আল্লাহ রক্ষা করুন।
শবে বরাতের পরদিন রোজা রাখাকে অনেক আলেম মুস্তাহাব বলেছেন। এ ব্যাপারে একটি হাদীস আছে। যার বর্ণনা সূত্র নিয়ে মুহাদ্দিসগণ আপত্তি করেছেন। শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাক্বী উসমানী হাফিজাহুল্লাহর মতে উক্ত হাদীসের দলিলের ভিত্তিতে ১৫ শা’বানের রোজাকে মুস্তাহাব বলা অনুচিত।
এজন্য আমরা সেফ সাইডে থাকার জন্য প্রতি মাসের মত শা’বান মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ তিন দিনই রোজা রাখতে পারি। নবীজি (সা) সারা বছরই আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। আর শা’বান মাসে নবীজি (সা) প্রায় সারা মাসই রোজা রাখতেন। তাই শুধু শবে বরাতের পর দিন শা’বানের ১৫ তারিখ রোজা না রেখে বরং ১৩, ১৪ ১৫ তারিখ তিন দিনই রোজা রাখি। এতে আইয়ামে বীজের আমলটি তো হলোই, সাথে ১৫ তারিখের রোজার পক্ষে যে মতটি আছে সেটার উপরও আমল হয়ে গেল।
শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস
এ রাতের বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতের ব্যাপারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদীসটি হচ্ছে সাধারণ ক্ষমা বিষয়ক। এই রাতে আল্লাহ দুই শ্রেণীর মানুষ ব্যাতীত সবাইকে ক্ষমা করে দিবেন। দুই শ্রেণী হচ্ছে ১। যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে ২। যাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ আছে। হাদীসের পাঠ এমন:
عن معاذ بن جبل, عن النبى (, قال : يطلع الله الى خلقه فى ليلة النصف من شعبان, فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن ]رواه ابن حبان وغيره, ورجاله ثقات, وإسناده متصل غلى مذهب مسلم الذى هو مذهب الحمهورفى المعنعن, ولم يحزم الذهبى بأن مكحولالم يلق مالك بن يخامر كما زعم, وإنما قاله على سبيل الحسان, راجع ,سبر أعلام النبلاء
মুআয ইবনে জাবাল বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের দুয়ার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজ-কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে। যখন কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাত ঘোষণা হয়, তখন মুমিন বান্দার কর্তব্য, এই সময় এমন সব নেক আমলের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাত লাভের উপযুক্ত হওয়া যায় এবং সবধরনের গোনাহ থেকে বিরত থাকা। গোনাহের কারণে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আগত রহমত ও মাগফেরাত থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
যেহেতু উপরোক্ত হাদীস এবং অন্যান্য হাদীসে অর্ধ-শাবানের রাতে ব্যাপক মাগফেরাতের ঘোষণা এসেছে, তাই এ রাতটি অনেক পূর্ব থেকেই শবে বরাত তথা মুক্তির রজনী নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। কেননা, এ রাতে গুনাহসমূহ থেকে মুক্তি লাভ হয় এবং পাপের অশুভ পরিণাম থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন হাদীস না থাকত, তবে এই হাদীসটিই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত। অথচ হাদীসের কিতাবসমূহে নির্ভরযোগ্য সনদে এ বিষয়ক আরো একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
শবে বরাত কি বিদআত
শবে বরাত পালন করা বিদআত না তবে সমাজে অনেক প্রচলিত বাড়াবাড়ি করার জিনিস রয়েছে, যা পালন করতে গিয়ে আমরা বিদআত পালন করি। তাই আমরা চেষ্টা করব অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করে, যতটুকু বলা হয়েছে তার মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইবাদত করার। শবে বরাতকে কেন্দ্র করে অনেক বিদআত ও শিরক কাজ আমাদের সমাজে প্রচলিত। কোনো কোনোটা আবার শিরক-বিদআত নয় বরং সাধারণ অনুচিত কাজ। সবগুলো বিস্তারিত না বলে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরছি। আমাদের সকলের উচিত এগুলো থেকে বিরত থাকা।
- হালুয়া রুটি বানিয়ে খাওয়া ও দান করাকে এ দিনের বিশেষ ইবাদত মনে করা।
- কবরে বাতি জ্বালানো।
- মাজারে গিয়ে সিজদা করা। (এটা হারাম! এতে ঈমান চলে যাবে!)
- আতশবাজি ও পটকা ফুটানো।
- এই রাতে গোসল করাকে বিশেষ সওয়াবের কাজ মনে করা।
- দল ধরে ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে “রাত্রি জাগরণ” সফল করা।a
- মসজিদে জমায়েত হয়ে সম্মিলিতভাবে নফল নামাজ পড়া।
- মসজিদে জমায়েত হয়ে এ রাতের উদ্দেশ্যে বিশেষ হালকায়ে যিকিরের আয়োজন।
- মসজিদে মসজিদে বা মহল্লায় মহল্লায় এই দিন উপলক্ষে বিশেষ খানা-দানা ও তবারকের ব্যবস্থা করা।
- রাতভর মসজিদের মাইক বাজিয়ে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার বা ওয়াজ মাহফিল করা।
শবে বরাত পালন করা কি জায়েজ
হ্যাঁ, শবে বরাত পালন করা জায়েজ। সকল মুসলমানের জন্য এ রাতের নফল ইবাদত অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই আপনিও চেষ্টা করবেন রাতে বেশি থেকে বেশি নফল ইবাদত করার। তবে অবশ্যই পরের দিনের ফজরের নামাজ যেন নষ্ট না হয়।
শবে বরাতের পর দিনের রোজা
শবে বরাতের পরদিন অর্থাৎ ১৫ শাবান রোযা রাখার বিষয়টিও বেশ প্রচলিত। উপরে আমরা হযরত আলী রা.এর সূত্রে যে হাদীস উল্লেখ করেছি, তাতে এ রোযার কথা বলা হয়েছে। আমরা বলে এসেছি, হাদীসটি সনদের দিক থেকে যদিও যয়ীফ, কিন্তু ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীসের ওপরও আমল করা যা। তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে এবং আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টিও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
আমরা চেষ্টা করেছি আজকের পোষ্টের সাহায্যে সবাইকে শবে বরাতের আমল ফজিলত ও বিভিন্ন হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার। আপনাদের যদি শবে বরাত নিয়ে কোন জিজ্ঞাসা থাকে। তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করবেন। শবে বরাতের শুভেচ্ছা বার্তা, স্ট্যাটাস ও উক্তি পেতে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।