২৬ মার্চ রোজ মঙ্গলবার পুরো বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস পালন করা হবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম পাকিস্তানের থেকে পৃথক হয়ে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি উদযাপন করার জন্য বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে থাকে। বাংলাদেশের সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতা করা হয়। যেখানে স্বাধীনতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্যবহার করে রচনা তৈরি করতে হয়। বিচারক মন্ডলী সবার স্বাধীনতা দিবস রচনা যাচাই-বাছাই করে বিজয়ী ঘোষনা করে। তাই আপনাদের জন্য ২৬ শে মার্চ রচনা এখানে দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতা দিবস রচনা ২০০ শব্দ
ভূমিকা:
২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, একটি ঐতিহাসিক দিন যা আমাদের জাতির গৌরব ও বীরত্বের প্রতীক।
স্বাধীনতার পূর্বাবস্থা:
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেলেও বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকে। অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন সহ বহুমুখী অবিচারের শিকার হতে থাকে বাঙালি জাতি।
মুক্তিযু*দ্ধ:
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর নির্মম হামলা চালালে শুরু হয় নয় মাসের র*ক্তক্ষয়ী মুক্তিযু*দ্ধ।
স্বাধীনতা অর্জন:
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার তাৎপর্য:
- স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় অহংকার ও গৌরবের প্রতীক।
- স্বাধীনতা আমাদের মৌলিক অধিকার যা আমাদের জীবনকে করে তোলে সুন্দর ও অর্থপূর্ণ।
- স্বাধীনতা আমাদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য।
উপসংহার:
স্বাধীনতা আমাদের অমূল্য সম্পদ। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধারণ করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিতে হবে।
স্বাধীনতা দিবস রচনা ৫০০ শব্দ
ভূমিকা:
বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা রয়েছে সুদীর্ঘ র*ক্তঝরা ইতিহাস। এক সাগর র*ক্ত ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা।
মুক্তিযু*দ্ধের প্রেক্ষাপট:
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তান লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের শাসন শোষণ ও বঞ্চনার মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রকম ভাবে শোষণ করা শুরু করে। এবং এর প্রথম আঘাত হানে আমাদের সংস্কৃতির উপর। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মানুষ স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, তারপর অনুষ্ঠিত হয় ৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন,৬৬ সালের ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযু*দ্ধ এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ:
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামে এদেশের নিরীহ মানুষের উপর গণহ*ত্যা চালায়। তারা তৎকালীন ঢাকার ইউপিআর সদরদপ্তরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন আবাসিক হলে ছাত্র দের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হ*ত্যা করে। এ সময় আশেপাশে যাদের পায় তাদের এ ক্রসফায়ার করে ঘটনাস্থলে মেরে ফেলা হয়। তারা শুরু করে পৃথিবীর নৃশংসতম গণহ*ত্যা। এরপর বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ক্রসফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। এদেশের নিরীহ মা বোনদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জোর করে ধর্ষণ করে। বীর বাঙালি তখন গেরিলা যু*দ্ধের মধ্য দিয়ে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। সর্বশেষ ভারতের মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে 16 ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।
স্বাধীনতার ঘোষণা:
২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। গ্রেপ্তারের পূর্বে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন:
১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কারন সে সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি ছিলেন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে:
৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তি বাহিনী ও ভারতের মিত্র বাহিনী যৌথভাবে হানাদার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ৬ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৪ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করলে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। নিশ্চিত পরাজয় দেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে হ*ত্যা করে। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে ।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চূড়ান্ত বিজয়:
১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ঢাকার সোহার্দী উদ্যানে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ফলে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।
উপসংহার:
নয় মাস র*ক্তক্ষয়ী যু*দ্ধ আর লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জন করেছে এই স্বাধীনতা। এক সাগর র*ক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে আমরা আমাদের জীবন দিয়ে রক্ষা করব। রুখে দাঁড়াবো স্বাধীনতার বিপক্ষে সকল অপশক্তিকে। সকলে মিলে একসাথে কাজ করে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।
স্বাধীনতা দিবস রচনা ১০০ শব্দ
ভূমিকা:
২৬ মার্চ, একটি ঐতিহাসিক দিন যা বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে। ১৯৭১ সালের এই দিনে, দীর্ঘ নয় মাসের র*ক্তক্ষয়ী যু*দ্ধের পর, আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের স্বাধীন স্বর্ণময় বাংলাদেশ। আজকের এই রচনায় আমরা স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য, এর ইতিহাস এবং আমাদের কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করবো।
স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য:
স্বাধীনতা দিবস আমাদের জন্য শুধু একটি ছুটির দিন নয়, বরং এটি একটি গৌরবোধ ও ঐক্যের দিন। এই দিন আমরা স্মরণ করি সেই সকল শহীদদের যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। আমরা পুনরায় প্রতিজ্ঞা করি আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
স্বাধীনতা দিবসের ইতিহাস:
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকারের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর গণহ*ত্যা চালায়। এর প্রতিবাদে সারাদেশে শুরু হয় মুক্তিযু*দ্ধ। নয় মাসের যু*দ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বাধীনতা দিবসের কর্তব্য:
স্বাধীনতা দিবস আমাদের সকলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন আমাদের কর্তব্য:
- স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।
- দেশের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যপরায়ণতা অনুভব করা।
- দেশের উন্নয়নে নিজেদের ভূমিকা রাখা।
- সাম্প্রদায়িকতা ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে অনুসরণ করা।
উপসংহার:
স্বাধীনতা দিবস আমাদের জন্য একটি পবিত্র দিন। এই দিন আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি যে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবো এবং দেশকে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করবো।
২৬ শে মার্চ রচনা
ভূমিকা:
স্বাধীনতা মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীব প্রায় প্রতিটি জাতিকেই সংগ্রাম করতে হয়েছে, র*ক্ত দিতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। বাংলাদেশও এমনিভাবেই স্বাধীনতা পেয়েছে। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস । ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পরাধীনতার গ্লানি ধুয়েমুছে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আজ বাংলাদেশ একটি গৌরবময় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। প্রতিবছর ২৬ মার্চ এদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় জাতীয় মর্যাদার সাথে। দিনটি আমাদের কাছে আনন্দের ও গৌরবের।
স্বাধীনতার পটভূমি
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বৈষম্যমূলক আচরণ করে পূর্ব বাংলার মানুষ তথা বাঙালিদের সাথে। প্রথমেই বাঙালিদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানা হয়। সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে এককভাবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হলো। বাঙালিরা তা মেনে নিল না। গড়ে উঠল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলার তরুণদের জীবন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালিদের রাজনৈতিক ঐক্য যুক্তফ্রন্ট বিজয় অর্জন করল। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে অল্পকালের মধ্যেই ভেঙে দিল প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকার। অল্পকালের মধ্যেই গড়ে উঠল ছয়দফা ও এগার দফা আন্দোলন। এ আন্দোলন ক্রমে ক্রমে প্রবল গণআন্দোলনে রূপলাভ করল। আবার হ*ত্যাকান্ড ঘটল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। গণআন্দোলন গণবিস্ফোরণে পরিণত হলো। আন্দোলনের চাপের মুখে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে নির্বাচন দিলেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কিন্তু বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না। তার পরিবর্তে শুরু হলো নানারকম তালবাহানা ও ষড়যন্ত্রের খেলা। আলোচনার নামে অযথা কালক্ষেপণ শুরু হলে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর; জঘন্যতম হ*ত্যাকাণ্ড চালায়। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান (পরে সেনাবাহিনী প্রধান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি)।
স্বাধীনতা যু*দ্ধ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর, ১০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীনতা যু*দ্ধ শুরু হয়ে যায়। কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে এ যু*দ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। অভিজ্ঞ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ ব্যূহ। হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও হ*ত্যাযজ্ঞ চালায়। আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় অগণিত মানুষের ঘরবাড়ি। যাকে পায় তাকেই গুলি করে মারে। লুটপাট চলে। এ অবস্থায় সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত বাঙালিরা পাকিস্তানের সাথে বিদ্রোহ করে যোগ দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু*দ্ধে। দেশের প্রায় এক কোটি লোক প্রাণের ভয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তারা অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতাযু*দ্ধে অংশগ্রহণ করে। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, চাকুরে ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য। ক্রমে ক্রমে মুক্তিযু*দ্ধ ভয়াবহ রূপলাভ করে। বিপর্যস্ত হতে থাকে হানাদার বাহিনী। সারা দেশে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে মার খেতে থাকে। শেষপর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে। নয় মাসের র*ক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়।
স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের যাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল- তাই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস । ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হয়। তারপর থেকে প্রতিবছর এ দিনটি একটি স্মরণীয় দিবস হিসেবে জাতীয় মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে। এদিন দেশের সকল বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকে। দিবসটি উদযাপনের জন্য বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সমস্ত ভবনে জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। ঢাকায় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতার অনুষ্ঠান। সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ভোরবেলা গণজমায়েত হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে, ফাতেহা পাঠ করা হয়, শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধে। ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানেও শহিদ মিনারে এবং বিদ্যালয়গুলোতে নানা উৎসব আয়োজন হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। মসজিদ মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। শোভাযাত্রা ও আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। খেলাধূলা হয়। সরকারি ও বেসরকারি ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা শোভা পায়। এভাবে সমগ্র দেশে ঘটা করে বিশেষ মর্যাদার সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হয়।
উপসংহার
পরাধীন জাতি পশুর চেয়েও অধম। তাই স্বাধীনতা এত আনন্দের, এত গৌরবের। স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ জাতীয় জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। দেশের প্রতি মানুষের মনে নতুন করে ভালোবাসা জন্য নেয়, নতুন চেতনায় উজ্জীবিত হয় মানুষ। বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। স্বাধীনতাকে রক্ষা করার শপথই হোক স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মূলমন্ত্র।
স্বাধীনতা দিবস রচনা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি–প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে।
— শামসুর রাহমান
কবিতার এ ছত্রেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। স্বাধীনতার বীজপত্র হিসেবে এমন একটি কবিতাই যথেষ্ঠ। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। অনাহারী একজন গৃহহীন পথের লোকও ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীনতা কামনা করে। স্বাধীনতার অর্থ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে সার্বভৌম আত্মমর্যাদা নিয়ে দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রা। স্বাধীনতা প্রত্যেক জাতির অমূল্য সম্পদ। যে জাতি যেদিন স্বাধীনতা লাভ করে সেদিনটি জাতীয় জীবনে এক গৌরবান্বিত, আনন্দঘন ও তাৎপর্যময় দিন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস: স্বাধীনতা যে কোনো জাতির জন্যে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীনতা আমাদের সামনে স্বর্ণ দুয়ার খুলে দেয়। যে দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা আমাদের যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। স্বাধীনতা দিবস জাতীয় জীবনের একটি লাল তারিখ, স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ২৬ এ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামের। ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ এ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নামের অন্তর্ভুক্তি ঘটে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস এ দিনটিকে ঘিরে রচিত হয়েছে।
এ দিনের নবীন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। স্বাধীনতা দিবস জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদার বর্ণিল স্মারক। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ আমরা বিশ্বের বুকে যে স্বাধীন সত্তার জানান দিয়েছিলাম, তা আজো মাথা উঁচু করে রেখেছে আমাদের। সে এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রপুঞ্জের মতো অসংখ্য অবিস্মরণীয় ঘটনা কাহিনীর। পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার জন্যে র*ক্তক্ষয়ী যু*দ্ধে।
র*ক্তস্নাত দোঁআশ মাটি ভিত্তি করে আবির্ভাব ঘটেছিল নতুন করে এ জতির। যে যেভাবে পারে অংশগ্রহণ করেছিল এই মহান মুক্তিযু*দ্ধে। এক অবিস্মরণীয় সম্মিলনের ঐকতানে মিলিত হয়েছিল এ জাতি। স্বাধীনতা যু*দ্ধের ঐকতানে সিম্ফনিতে মিলিত হয়েছিল সবাই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ স্বাধীনতা। আমরা ভুলি নি — ভুলি নি সেই বীরত্ব গাঁথা, ভুলিনি শহিদদের মহান আত্মত্যাগ।
অন্যান্য ঘটনা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশ্বের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে একটি আদর্শ –উজ্জ্বল দিক। কোনো জাতিকেই জন্মভূমির জন্য এতো করে এমনভাবে আত্মত্যাগ করতে হয় নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার মহান পতাকা এদেশের সুজলা – সুফলা – শস্য – শ্যামল ভূমিতে উঠাতে সক্ষম হয়েছিল। এজন্যে এ দেশের মানুষকে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় সংগ্রাম করতে হয়েছিল অস্ত্র সজ্জিত এক শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে। অবশেষে তারা সেই অকুতোভয় সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। ফলে আমরা লাভ করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ— ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি: ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ব্রিটিশ — ভারত থেকে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন এই স্বাধীন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং এটি তখন পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রত্যাশা ছিল তাদের সব ধরনের দমন – নিপীড়ন, অন্যায় – অত্যাচার শাষন – শোষনের অবসান ঘটবে।
কিন্তু শোষণ ও বঞ্চণার অবসান হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতে পাকিস্তানি শাসকচক্র এ অঞ্চলে তাদের তাবেদারদের মাধ্যমে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল। শোষণ – নিপীড়ন – নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল এদেশের মানুষ। তখন এদেশের মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শাসকচক্রের মুখোশ। তখন থেকেই বাঙালির মনে স্বাধীনতার চেতনা সঞ্চায়িত হতে থাকে।
আমাদের ভাষা – সাংস্কৃতিক – ভৌগলিক অবস্থান সবকিছুই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার বিপক্ষে। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই আঘাত আসে আমাদের ভাষার ওপর। তৎকালীন শাসকচক্র উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে জোর করে ঘোষণা করলে প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এদেশের ছাত্র সমাজ এবং সাধারন মানুষ। ১৯৪৭ সাল থেকে একটু একটু করে ভাষার জন্যে সঞ্চারিত হওয়া আন্দোলন আস্তে আস্তে বেগবান হয়ে চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালে।
রাজপথে বুকের তাজা র*ক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের গরবিনি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজ প্রোথিত করেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষা শহিদেরা, তারই স্মারক আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বোত্তম প্রাপ্তি বাঙালির — বাংলা ভাষাভাষী মানুষের স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা দিবস ও বিভিন্ন আন্দোলন: স্বাধীনতা একটি শব্দ শব্দ হলেও তা কখনোই একক কোনো দিবস বা কার্যের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। একে অর্জন করতে, একে পেতে হলে অনেক ত্যাগ অনেক আত্মহুতি অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও একদিনে আসে নি। কিংবা একক কোনো প্রচেষ্টার বিনিময়ে অর্জিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ঘটা বিভিন্ন দমন নিপীড়ন ও শোষণ বঞ্চনার প্রস্ফুট বিস্ফোরণের ফল হল আজকের স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের পশ্চাতে রয়েছে — ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনেরই অংশ। স্বৈরাচারী পাকিস্তান শাসক বারবার চেষ্টা করেও এদেশের মানুষকে দমন করতে পারে নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ কে ভোট দিয়েছিল, এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সরকার গঠন করতে পারে নি। নির্বাচনে জয়ের পরেও সংসদে বসতে দেয়নি পাকিস্তানি শাসকচক্র।
তারা বিন্দুমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়নি। স্বৈরাচারী পাকিস্তান শাসকচক্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করেছিল। ফলে ক্ষমতায় যেতে পারে নি এদেশের মানুষ। প্রতিবাদে গর্জে উঠলো তারা। পাকিস্তানি হায়েনারা এদেশের ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাল, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রচনা করতে থাকলো একের পর এক বিভীষিকাময় হ*ত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজেদের মুক্তির আন্দোলনে, জড়িয়ে পড়ল মহান মুক্তিযু*দ্ধে।
স্বাধীনতা যু*দ্ধের নয় মাস: ১৯৭১ সালের ২৫ এ মার্চ অন্ধকার রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র অবস্থায় অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা নির্বিচারে চালায় হ*ত্যাযজ্ঞ। ২৫ এ মার্চ রাতে ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ এ মার্চ যার যা আছে তাই নিয়ে সর্বত্র শত্রুর মোকাবিলা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করে যে যেভাবে পারেন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে একত্র হন।
গ্রামে – গঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, কৃষক, সৈনিক, পুলিশ, আনসার সবাই মিলে যার যার অঞ্চলে আঞ্চলিক কমান্ড তৈরি করে বিক্ষিপ্তভাবে শত্রুর ওপর আক্রমন চালাতে থাকে। কতিপয় বিবেকহীন বিশ্বাসঘাতক আলবদর, রাজাকার, আল — শামস ছাড়া গোটা জাতি মুক্তিযু*দ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ —এ মার্চ চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র হতে চট্টগ্রামের স্থানীয় জননেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২—৩ মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত ও অসংগঠিত অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যু*দ্ধ চলতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এ সরকার মুক্তিযু*দ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব দেয়।
দেশের সমগ্র সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা কর্মীদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠতে থাকে। চার পাঁচ মাস পর্যন্ত মুক্তিযু*দ্ধের গতিবিধি ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর ভারত সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করা শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম বৈপ্লবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ দিকে দেশের অভ্যন্তরে পাক — হানাদার বাহিনীর ওপর চলে প্রচণ্ড গেরিলা আক্রমণ।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে মুক্তিযু*দ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য এগারটি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে মুক্তিযু*দ্ধ সংগঠিত ও তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিপ্লবী অনুষ্ঠান ও রণসংগীত মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশবাসীকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে এই যু*দ্ধে উৎসাহিত করতে থাকে। প্রবাসী সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানায় এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চলে। এমনিভাবে নয় মাস যু*দ্ধের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভূখণ্ড স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বাধীনতা দিবস উদযাপন: প্রতিবছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য আমরা ওই দিন ভোরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এ দেশের সর্বস্তরের জনগণ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। এ দিনের অনুষ্ঠানমালা আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত ও উজ্জীবিত করে।
স্বাধীনতার চেতনা ও তাৎপর্য: আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটির প্রধান তাৎপর্য হচ্ছে— এ দিনটি সমগ্র দেশবাসীর বহুকাল লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্বর। এই স্বাধীনতা দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ। স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছর পর এখনো অসংখ্য লোক অশিক্ষিা ও দারিদ্র্য কবলিত অবস্থায় রয়েছে। জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বেকারত্বের জালে আবদ্ধ যুবক বেছে নিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয় ও সমাজবিরোধী পথ। এখনো আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারি নি। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সুখী – সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করা।
পরিস্থিতি উত্তরণের উপায়: অজস্র র*ক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে কারো ব্যক্তিগত বা দলগত চোরাবালিতে পথ না হারায় সেই প্রচেষ্টা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরো কঠিন। আজ বিশ্বের দিকে দিকে উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে আমাদেরও সৃষ্টি করতে হবে উন্নয়নের ধারা। দেশ গড়ার কাজে আজ প্রয়োজন সমগ্র জাতির নতুন করে শপথ গ্রহণ। সর্বপ্রকার স্বৈরতন্ত্র থেকে থেকে দেশকে মুক্ত করে আত্মশক্তিকে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে।তবেই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা বনাম অপশক্তি: যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত চার দশকেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারে নি। স্বাধীনতার পর বার বার সামরিক অভ্যুত্থান, হ*ত্যা আর র*ক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী দেশি ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুব সমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্বের হার, জনস্ফীতি, আইনশৃংখলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল্য লক্ষ্য বা চেতনাকে বিপন্ন করে চলছে। স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী কার্যকলাপ বার বার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাহিরে।
প্রকৃত স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনপ্রিয় মানুষ তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার হতে বারবার বঞ্চিত হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এজন্য দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন স্বাধীনতার প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের সত্যিকার ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীর করণীয়: স্বাধীনতা দিবসে শপথ নিতে হবে যে, বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতাকে জাতীয় জীবনে স্থিতিশীল করে রাখার শথপ নিয়ে দেশ ও জাতির জন্যে আমরা আমাদের কাজ করে যাব। স্বাধীনতা দিবসের চেতনাকে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। দেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই স্বাধীনতা দিবসের সত্যিকারের তাৎপর্য আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হব।
আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সমস্যা, সংকট, অভাব, অনটন, অশিক্ষা, দারিদ্র্য দূর করে দেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সকল দিক থেকে অর্থবহ হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা এলেও অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো আসে নি। অর্থনৈতিক মুক্তি আসলেই স্বাধীনতা দিবসের চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, আমাদের সকলকে তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে, জাতির কল্যাণের জন্যে একত্রে কাজ করে যেতে হবে।
উপসংহার: স্বাধীনতা একজন মানুষের জন্মগত অধিকার। অনেক র*ক্ত, ত্যাগ — তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। এর জন্যে ৩০ লাখ মানুষকে শহিদ হতে হয়েছে, ২ লাখ মা—বোনকে তাদের ইজ্জত দিতে হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ স্বাধীনতাকে আমাদের যে কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে। সুখী, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারলে স্বাধীনতা যু*দ্ধের শহিদদের স্বপ্ন পূরণ হবে।